অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি’। এটা সম্ভব হলে আমরা আশা করি জিনিসপত্রের দাম আরও কমে আসবে।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার (ডিসেম্বর ১৬) সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি একথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আমরা এখনো পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে। গত কয়েক মাসে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে এবং বাজার তদারকির মধ্য দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের হাতে গুম হওয়ার ব্যক্তিরা এখনও ভয়ে মুখ খুলছে না। তাদের ভয় কিছুতেই কাটছে না এজন্য যে হঠাৎ যদি ওই জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। তাদের নিরাপত্তায় সরকার সব কিছু করছে।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বিগত সরকারের হাতে খুন গুম হওয়ার ব্যক্তিদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া রিপোর্টে কমিশন সদস্যরা এখন পর্যন্ত পাওয়া এক হাজার ৬৭৬টি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছেন। গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন।
সেই প্রসঙ্গে টেনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে গুম কমিশনসহ ১৫টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন পূর্ণোদ্যমে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। গুম কমিশন গত পরশু তাদের প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করে গেছেন। গুমের শিকার বহু পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
ড. ইউনূস বলেন, এই প্রতিবেদন পড়ার আগেই আপনাদের সাবধান করে রাখি, এটা একটা লোমহর্ষক প্রতিবেদন। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা। সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে ঘটনাচক্রে যারা এখনো বেঁচে আছেন তারা আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস করছেন না। তাদের ভয় কিছুতেই কাটছে না। তাদের ভয়, হঠাৎ যদি ওই জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এ প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে।
আমি আশা করছি, কমিশনগুলো এখন থেকে নিয়মিতভাবে তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা পেশ করতে থাকবে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন তিনি। সরকার প্রধান তার ভাষণে বলেন, এসব হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত পতিত স্বৈরশাসক ও তার দোসরদের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আসামিদের বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব ধরনের সুযোগ তারা পাবেন। বিচার প্রক্রিয়া সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বিচারের যেকোনো অংশ চাইলে যে কেউ রেকর্ড করার সুযোগ পাবেন।
ড. ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিসি) প্রসিকিউটর করিম খান সম্প্রতি আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি আইসিটি প্রসিকিউটর এবং অন্যান্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয়েছেন এবং আইসিটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আলাদাভাবে আমরা গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করবো বলে তাকে জানিয়েছি।
মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা আপনাদের কষ্টে সমব্যথী। তবে আমরা জানি সরকারের কাজ কেবল সমবেদনা জানানো নয়। আমরা আপনাদের কষ্ট কমিয়ে আনতে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের কাছে ওয়াদা করেছে বাজারে পণ্য সরবরাহের কোনো সংকট হবে না। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যদি কেউ কৃত্রিম কোনো সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে আমরা তাকে কঠোর হাতে দমন করবো। বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বিকল্প কৃষি বাজার চালু করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল করতে সবাইকে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিগত বছরগুলোতে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পরাজিত শক্তি সক্রিয় বলেও জানান তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার অবস্থায় ছিল জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিগত বছরগুলোতে ঋণে টাকায় বড় বড় প্রকল্পের মোড়কে বিপুল টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচার হয়েছে। সেই টাকা এখন দেশে গোলযোগ সৃষ্টির কাজে, সংহতি বিনষ্টের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতি তখন ভেঙে পড়ার অবস্থায়। গত চার মাসে এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা এবং নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়নি। ব্যাংক যতই দুর্বলই হোক তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথমদিকে আমানতকারীর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এখন সেটা তুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে আমানতকারীর আমানত ফেরত দেওয়ার জন্য নতুন টাকার সরবরাহ দিতে প্রস্তুত হয়েছে। আশা করি এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সবার আস্থা ফিরে আসবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন আয়োজন ও সংস্কার ছাড়াও আপনারা আমাদের ওপর অনেকগুলো দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে আমরা বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি পেয়েছি। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।