দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে শুরু থেকে চুপ ছিলেন মাশরাফি। যার কারণে ধস নামিয়েছেতার জনপ্রিয়তায়।
এতদিন চুপ থাকলেও বুধবার বুধবার (১৪ আগস্ট এ নিয়ে মুখ খুলেছেন মাশরাফি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে থাকতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন সাবেক অধিনায়ক।
দেশের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যর্থতা নিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘এখন এইগুলোর উত্তর দেওয়াটা (নীরব থাকার) আমার কাছে মনে হয় একদম শুধু শুধু হবে। আর যদি এক কথায় উত্তর দিই, তাহলে বলতে হয় আমি আসলে ব্যর্থ হয়েছি এখানে। অ্যাবসুলেটলি ব্যর্থ হয়েছি।’ ‘দ্বিতীয় কথা হচ্ছে কথা যদি বলতে হতো, যৌক্তিক কোটা সংস্কার নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছিল শুরুতে; সবাই যখন চেয়েছিল আমি কথা বলি। তখন যৌক্তিকভাবে কোটা সংস্কার হবে এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছিল। বা আমার কাছে মনে হচ্ছিল কোটা সংস্কার হয়তো হবে।’ ‘কিন্তু তারপরে যে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকল, এমন একটা পরিস্থিতি হলো যে, যখন সবাই চাচ্ছে আমি একটা স্ট্যাটাস দিই বা পাশে থাকি। তখন পরিবেশটা এমন জায়গায় গিয়েছে, আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি যদি এখন স্ট্যাটাস দিই বা যেকোনো কিছু লেখি; সেটাকে কেন্দ্র করে যদি আরও বড় কিছু হয়ে যায়, ওই জিনিসটা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা আমার আছে কি না।’-যোগ করেন তিনি।
সরকারের সঙ্গে কথা বলে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন মাশরাফি, ‘সবকিছু মিলিয়ে আসলে ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে, আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে আমি চেষ্টা করিনি সেটা না। আরেকটা বিষয় হলো আমি স্ট্যাটাসের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কিছু করা যায় কি না।’
‘আমি যদি একটা স্ট্যাটাস দিতাম, তাতে করে যা কিছু ঘটেছে, হয়েছে; তার থেকে কম হতো না। বরং সার্বিকভাবে আমার যে ভয়টা কাজ করছিল, আমার স্ট্যাটাসের কারণে যদি জিনিসটা আরও বড় হয়ে যায় তখন সেটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে কি না।’- বলেন মাশরাফি।
মাশরাফি বলেন, ‘দলের বাইরে গিয়ে কিছু করতে হলে আমাকে পদত্যাগ করতে হতো। সেটা যদি করতাম, তাহলে এখন নিশ্চয়ই আমার অনেক প্রশংসা হতো। কিন্তু প্রতিটি সময়ের বাস্তবতা আলাদা থাকে। ওই সময় যদি পদত্যাগ করতাম, তাহলে আরও বড় কিছু হয় কি না, বা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না, এরকম অনেক কিছু ভাবতে হয়েছে। আমি যদি সেই ভাবনাগুলি সব তুলে ধরি, সেটারও পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকবে। কিন্তু সম্ভাব্য পরিণতি বা অনেক দিক ভাবতে হয়েছে আমাকে।’
‘নড়াইলের মানুষের কাছেও আমার দায়বদ্ধতার ব্যাপার ছিল। নড়াইল-২ আসনের মানুষের অনেক আশা আমাকে ঘিরে। তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, নড়াইলকে একটা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। সেই মানুষগুলোর কাছে কি জবাব দেব? এরকম নানা কিছু ভাবতে হয়েছে।’
মায়ের জন্য নড়াইলে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন মাশরাফি। মূলত, সেই বাড়িটিই পুড়িয়ে দিয়েছে। মাশরাফি বলেন, ‘নড়াইলের বাড়িটা করেছিলাম মায়ের জন্য। এখন শেষ। অনেকেই বলেছেন মামলা করতে, ব্যবস্থা নিতে। ছবি-ভিডিও সবই আছে অনেকের কাছে। তবে আমি বলেছি, এসব করব না। আমার বাবাকেও বলে দিয়েছি। এখনকার সরকার বা ভবিষ্যতে নির্বাচন করেও যে সরকার আসুক, কারও কাছেই বিচাই চাইব না। কোনো অভিযোগ নেই। খুলনা-যশোর থেকে বা ঢাকা থেকে গিয়ে কেউ এই বাড়ি ভাঙেনি। নড়াইলের কোনো না কোনো জায়গা থেকে উঠে আসা মানুষই পুড়িয়েছে। নড়াইলের মানুষের বিরুদ্ধে বিচার আমি চাইব না। নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছি। হয়তো কোনো ভুল করেছি, সেটার ফল পেয়েছি। কষ্ট আছে অবশ্যই, তবে রাগ-ক্ষোভ নেই কারও প্রতি। আমার প্রতি এখনও কারও ক্ষোভ থাকলে, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’
অগ্নিসংযোগের আগে সেই বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন মাশরাফির মা-বাবা। তবে নিরাপদে সরে যেতে পেরেছেন তারা। বাড়িটিতে মাশরাফির ক্রিকেটীয় জীবনের সব স্মারক ছিল। সেগুলোও পুড়ে গেছে।
এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘আমি তো এমন বড় ক্রিকেটার নই বা এমন নয় যে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে যা কিছু পেয়েছি, প্রায় সব ওখানেই ছিল। ঢাকায় কিছু নেই। সব পুড়ে শেষ। এমন নয় যে, স্মারকগুলির প্রতি আমার টান অনেক বেশি ছিল। তবে মাঝেমধ্যে দেখতে ভালো লাগতো। অনেক লোকে বাড়িতে যেতো এসব দেখতে। সবার জন্যই তো দুয়ার খোলা ছিল। কিছুই আর নেই। তবে দিনশেষে সান্ত্বনা যে, বাবা-মা অন্তত প্রাণে বেঁচে গেছেন। যা গেছে, কথা বলে লাভ নেই।’