গাজা যুদ্ধ অষ্টম মাসে গড়িয়েছে। এই সংঘাতের সমাধান দুঃখজনকভাবে এখনো অনেক দূরে বলেই মনে হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার হামাস হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি ইসরাইলের। যদি এই সংখ্যা সঠিক হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, একই সময়ে অন্তত এর দ্বিগুণ বা তিনগুণ হামাস যোদ্ধা ইসরাইলি হামলায় আহত বা পঙ্গু হয়েছেন।
যুদ্ধ শুরুর আগে গাজায় প্রায় ৩০ হাজার হামাস যোদ্ধা থাকার কথা জানিয়েছিল ইসরাইল। এই পরিপ্রেক্ষিতে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহে লুকিয়ে থাকা সব শেষ হামাস যোদ্ধা নিধনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহুর সাফ কথা, ইসরাইলের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ এই হামাস যোদ্ধাদের কোনো মূল্যে নিশ্চিহ্ন করা হবে।
লক্ষণীয়, ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) হাতে নিহত হওয়া হামাস যোদ্ধাদের হিসাব কীভাবে রাখা হচ্ছে, তা পরিষ্কার করেনি ইসরাইল। এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি আইডিএফ বা ইসরাইল। গাজায় নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে। নিহতদের মধ্যে সামরিক-সক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষ তথা ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষের আনুমানিক সংখ্যার ওপর ভিত্তি করেই যে ‘১৩ হাজার হামাস নিহত’ হওয়ার দাবি করা হচ্ছে, এমন দাবি অমূলক নয়।
নেতানিয়াহু বলে আসছেন, বাকি হামাস যোদ্ধারা রাফাহ শহরের নীচে সুড়ঙ্গে (টানেল) লুকিয়ে আছে। এই দাবিও প্রশ্নের বাইরে নয়। এর কারণ, সত্যিই যদি তারা সুড়ঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে থাকত, তাহলে টানেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এতক্ষণে তাদের উত্তরে সরে যাওয়ার কথা! তাছাড়া আইডিএফ ও ইসরাইলি মিডিয়া এর আগে বলেছিল, হামাস যোদ্ধারা মধ্য ও উত্তর গাজায় সংগঠিত হয়েছে নতুন করে। এমন এক প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহুর রাফাহে বড় পরিসরে আক্রমণ চালানো এবং হামাস নির্মূলের মাধ্যমে গাজা যুদ্ধে বিজয় লাভের চিন্তা কতটা যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত? নাকি এর পেছনে অন্য পরিকল্পনা আছে!
হামাসের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখ্লে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং সামরিক নেতা মোহাম্মদ দেইফকে খুঁজে বের করতে পারছে না আইডিএফ। এই দুই নেতাকে বাইরে রেখে গাজা যুদ্ধে কখনোই বিজয় দাবি করতে পারে না তেলআবিব। উপরন্তু, হামাসের হাতে আটকে থাকা বাকি জিম্মিদের উদ্ধারেও ইসরাইল সফলতা পায়নি। আনুমানিক ২৪০ জিম্মির মধ্যে মাত্র তিনজনকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত করা হয়েছে। আলাপ-আলোচনা এবং হামাসের একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে আরো ১০০ জনেরও বেশি জিম্মি মুক্তি লাভ করেছে। অর্থাত্, অর্ধেকের বেশি জিম্মি এখনো হামাসের কব্জায় রয়েছে।
ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে গাজার রাফাহে বড় ধরনের অভিযানের পথে রয়েছেন নেতানিয়াহু, যা নিয়ে ইসরাইলের যুদ্ধ পরিচালনার ওপর আন্তর্জাতিক ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাপক হারে। বিশ্বজুড়ে ইউনিভার্সিটিগুলোতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলছে। এর চেয়ে বড় কথা, রাফায় হামলা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এমনকি নেতানিয়াহু যাতে রাফাহে হামলা চালাতে না পারেন, সেজন্য ইসরাইলে ভারী অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন। যদিও ইসরাইলের জন্য সম্প্রতি বাইডেন প্রশাসনের এক বিলিয়ন নতুন অস্ত্র চুক্তি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে।
গাজা যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে কিংবা রাফাহে আইডিএফ সত্যি সত্যিই বড় ধরনের অভিযান চালাবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট, নেতানিয়াহু চরম চাপে রয়েছেন। বলা হচ্ছে, নেতানিয়াহুর অধীনে ইসরাইল নজিরবিহীন মার্কিন বিরোধীতার মুখে পড়েছে।
৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখ্লে হামাস কেন অকাস্ম্যাত্ মর্মান্তিক আক্রমণ করে বসল, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। যদিও এ নিয়ে অনুমাননির্ভর অনেক কথা আছে। যেমন—এক. সৌদি আরব ও ইসরাইলের শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এজেন্ডার শীর্ষে ‘ফিলিস্তিনি ইস্যু’ তুলে ধরার জন্যই এই হামলা; দুই. দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে ওঠা ‘বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’ গাজার দুর্ভোগের বিষয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই হামাসের এভাবে হামলার পথ বেছে নেওয়া; তিন. হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের ক্ষোভকে এমনভাবে বাড়িয়ে তোলা, যাতে প্রবল শক্তি নিয়ে তেলআবিব এর প্রতিক্রিয়া জানায় এবং যার মধ্য দিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে। এ ধরনের নানা জল্পনাকল্পনা আছে হামাসের হামলা নিয়ে। সব মিলিয়ে বলা যায়, হামাস ইসরাইলের জন্য ফাঁদ পেতেছিল এবং সেই ফাঁদে পা দিয়ে চরম বিপদের মধ্যে পড়ে গেছেন নেতানিয়াহু।
বর্তমান পরিস্থিতি নেতানিয়াহুর জন্য বেশ কঠিনই। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি গাজা যুদ্ধ শুরু করেন, তা অর্জন থেকে এখনো অনেক দূরে। বরং আন্তর্জাতিক সমালোচনা তার কাজকে আরো কঠিন করে তুলছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ নিয়েও আলোচনা চলছে। তিনি মূলত তিন দিক থেকে চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন, যেখানে তার সামনে তেমন কোনো ভালো বিকল্প নেই।
প্রথমত, ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে ডানপন্থী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু সরকারের জোটের অন্যতম অংশীদারদের মধ্যে আরো অনেক চরম ডানপন্থী নেতা রয়েছেন, যাদের থেকেও ক্রমাগত চাপ আছে তার ওপর। বিশেষ করে, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এবং নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, নেতানিয়াহু দীর্ঘ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করবে তারা। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা গেছে, ৭১ শতাংশ ইসরাইলি নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চান। এর অর্থ, নতুন করে নির্বাচন হলে তিনি প্রায় নিশ্চিতভাবে হেরে যাবেন।
দ্বিতীয়ত, হামাসের হাতে এখনো বন্দী থাকা ১৩০ বা তারও বেশি ইসরাইলির পরিবার ও সমর্থকরা ক্রমাগত চাপ দিচ্ছেন নেতানিয়াহুর ওপর। জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য নেতানিয়াহুর ওপর অব্যাহতভাবে চাপ বাড়ছে। যদিও ইসরাইলি গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, ইতিমধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ জিম্মি নিহত হয়ে থাকতে পারে।
তৃতীয়ত, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কারণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই যুদ্ধ শেষ করতে চাইছেন ইসরাইলের প্রধান মিত্র জো বাইডেন। বাইডেন প্রশাসনের আশঙ্কা, অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করা না গেলে প্রগতিশীল ও আরব আমেরিকান ভোটাররা ডেমোক্র্যাটদের ভোট নাও দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অবধারতিভাবে প্রেসিডেন্ট পদ হস্তান্তর করা ছাড়া বাইডেনের সামনে বিকল্প পথ খোলা থাকবে না। এমন এক অবস্থায় নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেনের ধৈর্য্য ক্ষীণ হয়ে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। ইসরাইলে সরবরাহের অপেক্ষায় থাকা অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়া বাইডেনের এমনই এক সংকেত।
যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য সবশেষ মিশর ও কাতারের নেতৃত্বে আলোচনার বন্দোবস্ত করা হয়। দুঃখজনক বিষয়, সফলতার খুব কাছাকাছি এসেও থেমে যায় এই আলোচনা। যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সহজ অর্থ, নেতানিয়াহু আসলে যুদ্ধবিরতি চান না। এর ফলেও যে তার ওপর চাপ আরো বাড়বে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
চলমান যুদ্ধ আবারো এই প্রশ্ন সামনে এনেছে যে, ২০০৯ সাল থেকে নেতানিয়াহুর প্রায় অবিচ্ছিন্ন শাসনের অধীনে থাকা ইসরাইলের প্রতিবেশী ফিলিস্তিনির সঙ্গে পাশাপাশি থাকার বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোনো কৌশল নেই। এমনকি উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পর ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা কী হবে, সে বিষয়েও কার্যত রূপরেখা নেই নেতানিয়াহু সরকারের। এহেন পরিকল্পনার অভাবের কারণে উত্তর গাজায় ইতিমধ্যে ‘বিপজ্জনক ক্ষমতার শূন্যতা’ তৈরি হয়েছে, যার ফলে বিভিন্ন গ্যাং, গোষ্ঠী ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠতে পারে এই অঞ্চল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট কার্ট ক্যাম্পবেল সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, তা স্মরণ করিয়ে দেয়—…বেসামরিক জনগণকে অন্য অঞ্চলে ঠেলে দেওয়া কিংবা ব্যাপক সহিংসতার পরেও এসব অঞ্চলে বিদ্রোহ-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।’
এখন প্রশ্ন হলো, গাজার ভবিষ্যত্ কোন পথে? এই অঞ্চল নিয়ে মূল পরিকল্পনা ঠিক কী? নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, তার সরকার সংস্কারকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে (পিএলএ) কখনোই মেনে নেবে না। গাজার ওপর পিএলএর নিয়ন্ত্রণও মানবে না। নেতানিয়াহুকে বাদ দিয়ে যদি হিসেব করা হয়, সেখানেও বিপত্তি আছে। ইসরাইলের পক্ষে গাজা পরিচালনার জন্য কোনো জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর নেতাদের রাজি করানো গেলেও দুর্নীতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে তাও ভেস্তে যাবে। অন্যদিকে, এই অঞ্চল বা জাতিসংঘের বাইরের শক্তিগুলোরও এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হয়না। সুতরাং, প্রশ্ন এক জায়গাতেই খুরপাক খাচ্ছে—গাজার মানুষ যাবে কোথায়? বস্তুত, এভাবে বিরোধপূর্ণ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিরা কেবল হাতাশার সাগরেই হাবুডুবু খাচ্ছে। দুর্বলদের যেন কোনো আশ্রয় নেই! সব জায়গা কেবল শক্তিশালীদের জন্য।