দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেড় মাস অতিক্রান্ত হইয়াছে; কিন্তু এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হইয়াছিল তাহার জের এখনো শেষ হয় নাই। ইহার কারণে তৃণমূলে এখনো বন্ধ হয় নাই কোন্দল ও সংঘাত। ইহাতে তৃণমূলের সহিত কেন্দ্রের সৃষ্টি হইয়াছে একধরনের টানাপড়েন। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে দলে শৃঙ্খলা ফিরাইয়া আনিবার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি কতিপয় নির্দেশ জারি করিয়াছেন। তাহার মধ্যে রহিয়াছে—কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেহ কোনো থানা বা উপজেলা কমিটি গড়িতে পারিবেন না, ভাঙিতেও পারিবেন না। ইহার সহিত আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সংসদ সদস্যরা হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না। উপজেলা নির্বাচন তৃণমূল নেতাদের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। এখন কেহ প্রতিযোগিতা করিতে চাহিলে করুন; কিন্তু প্রতিযোগিতার নামে ঘরের মধ্যে একে অপরের সহিত শত্রুর মতো আচরণ করা যাইবে না। জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় যেমনটা ঘটিয়াছে, এইবার তাহার পুনরাবৃত্তি তিনি বা তাহারা চাহেন না।
আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ নেতা ওবায়দুল কাদের এমপি ২০১৬ সাল হইতে টানা তিন মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করিয়া আসিতেছেন। তাহার পিতা মোশাররফ হোসেন ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক এবং কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী। দুই মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বপালনকারী ওবায়দুল কাদের একসময় ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর সহকারী সম্পাদক। তাই একটি ঐতিহ্যবাহী ও আমাদের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি একজন সাংবাদিক হিসাবেও তিনি সকলের নিকট পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাই তিনি এবং তাহার নেত্রী তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে আমাদের তেমন কিছু বলিবার নাই; কিন্তু সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হইতে আমরা কি এই কথা বলিতে পারি যে, দেশে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এখন আর এমপিদের হস্তে রহিয়াছে? ইহা নির্বাচন কমিশনের হস্তে থাকিলেও কোনো কথা ছিল না; কিন্তু ইহা এখন ওসি, ইউএনও, এসপি ডিসি প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তাদের হস্তে চলিয়া গিয়াছে বলিলে কি অত্যুক্তি ও অন্যায় হইবে? আরো স্পষ্ট করিয়া বলিলে, নির্বাচন এখন একশ্রেণির কালোটাকার মালিকদের হস্তে কি চলিয়া যায় নাই? যাহাদের কথামতো চলিতেছে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি স্পর্শকাতর বিভাগের লোকজনও? এই কথা কি অস্বীকার করিবার উপায় আছে?
নির্বাচনের লাটাইটা কাহার হাতে চলিয়া গিয়াছে, তাহা সম্প্রতি আলোচিত নাটোর-১ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদের সরলোক্তি হইতে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। তিনি তাহার নির্বাচনে খরচ করা ১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা যে কোনো প্রকারে তুলিয়া লওয়ার ঘোষণা দেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন, ‘এটুকু অন্যায় আমি করব। তারপর আর করব না।’ ইহা বলিয়া তিনি সমালোচনা ও তোপের মুখে পড়িলে পরদিন আবার বলেন, ‘ভবিষ্যতে এভাবে সত্য কথা বলব না।’ রাজনীতিকে আমরা এমন পর্যায়ে লইয়া গিয়াছি যে, একজন এমপি কেন মন্ত্রীর পক্ষেও সত্য কথা বলা কঠিন। জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ২৫ লক্ষ টাকা; কিন্তু এই দেশের একজন পাগলও বিশ্বাস করিবে না যে, এই টাকায় এই দেশের কোনো নির্বাচনি বৈতরণি পার হওয়া যায়। একটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও জিতিতে হইলে আজ কোটি টাকা ব্যয় করিতে হয়। অনেক সমিতি বা ক্লাব নির্বাচনেও দেখা যায় টাকার ছড়াছড়ি। খুব বেশিদিন পূর্বের কথা নহে, গত জাতীয় নির্বাচনের সময় একজন প্রার্থী দম্ভ করিয়া বলেন যে, খালের পানি শুকাইয়া যাইবে, তাহার পরও তাহার টাকা শেষ হইবে না। এই যখন প্রকৃত বাস্তবতা, তখন উপজেলা নির্বাচনে একজন এমপি মহোদয়ের কতটা হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে? ইহাই কি আজিকার প্রধান জিজ্ঞাস্য নহে