ফেইসবুক পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও এক সহপাঠীকে দায়ী করে শুক্রবার রাতে আত্মহত্যা করেন ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। গত বছর এরকম রোজার মাসেই বাবাকে হারিয়েছিলেন তিনি।
এক বছরের ব্যবধানে স্বামী ও মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম।
কুমিল্লা নগরীর এই বাসিন্দা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, আমি জীবনে কারও ক্ষতি করিনি। কুমিল্লা শহরের কেউ বলতে পারবে না আমি কারও ক্ষতি করেছি। ওরা আমার এতো বড় ক্ষতি কেন করলো। একটা বিধবা নারীর এটাই প্রাপ্য ছিলো? আমি এখন সন্তানহারা। আমি এর বিচার কার কাছে দেব?
অবন্তিকার বাবা মো. জামাল উদ্দিন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল রোজার সময় তিনি মারা যান।
মৃত্যুর আগে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা মহাজন বাড়ি এলাকায়।
অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লা পুলিশ লাইনস উচ্চ বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। অবন্তিকার ছোট ভাই অপূর্ব আগামীতে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অবন্তিকার মা শবনম বলেন, শুক্রবার ইফতারের পর মেয়েকে বিষণ্ন দেখেছিলাম। তখন মন খারাপ কেন জানতে চাইলে অবন্তিকা শুধু বলেছিলো, এমনি। রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমাকে পানি দিয়ে গেল এক গ্লাস। এর কিছুক্ষণ পর ওর রুমে ফ্যানের শব্দ না পেয়ে ডাকাডাকি করি। কোনো সাড়া মেলেনি । পরে মই দিয়ে পূর্ব পাশের জানালা খুলে ফ্যানের সঙ্গে অবন্তিকাকে ঝুলে থাকতে দেখে।
তিনি বলেন, এরপর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পুলিশের একজন সদস্যসহ মেয়েকে নামিয়ে প্রথমে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ও পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক অবন্তিকাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শবনমের অভিযোগ, সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী নানাভাবে তাকে উৎপীড়ন করতে থাকলে অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে নালিশ করেছিলেন।
তিনি বলেন, কিন্তু সহকারী প্রক্টর ঘটনার বিচার করেননি, উল্টো মেয়েকে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। ওই ছেলের পক্ষ নেন তিনি। তখন আম্মান সিদ্দিকী আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন। আপত্তিকর মন্তব্য করতেন, হুমকি দিতেন। এসব ঘটনার বিচার চেয়ে না পেয়ে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন শবনম।
এদিকে অবন্তিকার আত্মহত্যার পেছনে সহপাঠীদের করা একটি জিডি দায়ী হতে পারে বলে দাবি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে হয়রানি করার অভিযোগে জিডিটি করেছিলো অবন্তিকারই কয়েকজন সহপাঠী। একাত্তরের কাছে তিনি দাবি করেছেন, সুইসাইড নোটে অবন্তিকা যা লিখে গেছে গেছে তার অনেক কিছুই ভিত্তিহীন। তার কাছে অবন্তিকা কখনো যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে আসেনি। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে দ্বীন ইসলাম বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণ হলে যে কোন শাস্তি পেতে তিনি প্রস্তুত।
এদিকে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ দাবি করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে কুমিল্লার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জোট। শনিবার নগরীর কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
এ সময় বক্তারা জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীসহ অবন্তিকার মৃত্যুর নেপথ্যে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
শুক্রবার রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে অবন্তিকা এ ঘটনার জন্য আম্মান সিদ্দিকী নামে তার এক সহপাঠীকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকেও এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন।
শুক্রবার রাত থেকে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দীকির বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ তুলেন। পরে দোষী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর শাস্তির দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযোগ ওঠা আইন বিভাগের (২০১৮-১৯) সেশনের শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে সহায়তাকারী ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত ও প্রক্টরিয়াল বডি থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
একাত্তরের দেশ–